প্রথম সামরিক শাসক ও তার রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী খতিয়ান

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী

by bdnewsinsider

গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য দুটি বিষয় হচ্ছে রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন বলেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলের বিশেষ করে প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ আন্তরিকভাবে প্রত্যাশিত এবং আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দলকে অংশগ্রহণ করার জন্য তাদের আন্তরিক আহ্বান শেষ পর্যন্ত বহাল থাকবে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের পর তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন তাদের মতামতে এ কথা জানিয়েছে। গত ২২ আগস্ট প্রকাশিত এ সংক্রান্ত লিখিত মতামতে জানানো হয়, নির্বাচন কমিশন কোনো দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে বাধ্য করতে পারে না এবং সে ধরনের কোনো প্রয়াস নির্বাচন কমিশন গ্রহণ করবে না। কমিশনে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ৯টি দল নির্বাচন কমিশনের সংলাপে অংশ নেয়নি। দুটি দলকে আবেদনের ভিত্তিতে আগামী সেপ্টেম্বরে সংলাপে অংশগ্রহণের জন্য সময় দিয়ে সম্মতি দেয়া হয়েছে। এখন বিএনপি যেভাবে চায় সেভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দৃশ্যত অনড় অবস্থানে আছে। কিন্তু অতীতে দলটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া তথা নির্বাচনের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি কীভাবে ধ্বংস করেছে সেই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তাদের বর্তমান বক্তব্য সম্পূর্ণরূপে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। বর্তমান লেখায় বিশেষত সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে বিএনপির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পাশাপাশি, প্রহসন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে দেশের প্রথম সামরিক প্রশাসক এবং বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীতে তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকারের নির্বাচনী খতিয়ান অতি-সংক্ষেপে অনুসন্ধানের চেষ্টা করা হচ্ছে।
‘আমি কোনোমতে সাইন করে জীবন বাঁচালাম’
১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল বন্দুকের মুখে বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন! যদিও পদত্যাগপত্রে শারীরিক অসুস্থতার কথা লেখা ছিল। অ্যাট বঙ্গভবন : লাস্ট ফেইজ শীর্ষক গ্রন্থে বিচারপতি সায়েম তার পদত্যাগ সম্পর্কিত কাহিনী বিস্তারিতভাবে লিখেছেন। এই বই থেকে অনেক অজানা ইতিহাস জানা যায়, যা দীর্ঘদিন ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল বিএনপি। বইটি থেকে আরো জানা যায়, রাষ্ট্রপতি সায়েমের একটাই দুঃখ ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের নির্বাচন করে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যেতে পারেননি। বিচারপতি সায়েম লিখেছেন, ‘জিয়া বঙ্গভবনে আসতেন মধ্যরাতে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। তার সাঙ্গপাঙ্গরা অস্ত্র উঁচিয়ে রাখত।… আমি প্রায়ই মনে করতাম এটাই বোধ হয় আমার শেষ রাত।’
একদিন রাত ১১টায় বুটের শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। সেনাপ্রধান জিয়া অস্ত্রশস্ত্রসহ বঙ্গভবনে আমার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন। জিয়াউর রহমান আমার বিছানায় তার বুটসহ পা তুলে দিয়ে বলেন, সাইন ইট। তার এক হাতে ছিল স্টিক, অন্য হাতে রিভলবার। আমি কাগজটা পড়লাম। আমার পদত্যাগপত্র। যাতে লেখা- ‘অসুস্থতার কারণে আমি রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলাম।’ আমি জিয়াউর রহমানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আট-দশজন অস্ত্রধারী আমার বিছানার চারপাশে অস্ত্র উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জিয়া আবার আমার বিছানায় পা তুলে আমার বুকের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে বললেন, ‘সাইন ইট।’ আমি কোনোমতে সই করে বাঁচলাম।
অভূতপূর্ব মহাকারচুপির ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট
১৯৭৭ সালের ৩০ এপ্রিল জেনারেল জিয়া তার শাসনকে বেসামরিক করতে ১৯ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। দক্ষিণপন্থিদের সঙ্গে নিয়ে একদিকে রাজনৈতিক বিরোধিতাকে দুর্বল করা এবং অন্যদিকে তার ক্ষমতার বৈধতা আদায়ের জন্য জিয়া ১৯৭৭ সালের মে মাসে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট বা রেফারেন্ডাম/গণভোটের আয়োজন করে। রেফারেন্ডামে ভোটার উপস্থিতি ছিল ২ শতাংশের নিচে, কিন্তু ভোটার উপস্থিতি দেখানো হয় ৮৮ শতাংশ। ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি না থাকার কারণে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা প্রিসাইডিং এবং পোলিং অফিসাররা জিয়ার পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন। দেখানো এই প্রদত্ত ভোটের মধ্যে জিয়ার পক্ষে দেখানো হয় ৯৯.৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’। যা ছিল সম্পূর্ণরূপে অসম্ভব ও অবাস্তব।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং আর্মি অ্যাক্ট ভঙ্গ
বাংলাদেশ আর্মি অ্যাক্টের ২৯২ এবং ২৯৩ বিধিতে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, সামরিক বাহিনীর কোনো সদস্য তার নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবে না। কিন্তু চাকরিরত অবস্থায় ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট থেকে জেনারেল জিয়া প্রার্থী হয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশ ১৯৭৮ অনুযায়ী, কোনো সরকারি চাকরিজীবী ও সরকারি বেতন গ্রহীতার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার সুযোগ ছিল না। কিন্তু জিয়া আইন ভঙ্গ করে জোরপূর্বক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হলে আর্মি, পুলিশ ও সরকারি চাকরিজীবীরা ন্যক্কারজনকভাবে জিয়ার পক্ষ অবলম্বন করে। প্রকাশ্য ও গোপন কারচুপির মাধ্যমে তিনি বিজয়ী হন।
দালাল আইন বাতিল
জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর বাহাত্তর সালে প্রবর্তিত দালাল আইন বাতিল করে ১১ হাজার সাজাপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ত্যাগ করে পাকিস্তানের নাগরিকত্ব গ্রহণকারীদের ১৯৭৬ সালের ১৮ জানুয়ারি দেশের প্রথম সামরিক শাসক বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ফেরত পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলেন। অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলকারী দেশের প্রথম সামরিক শাসক তার সেকেন্ড প্রক্লামেশন জারির মাধ্যমে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করে দালালদের ভোটার হওয়ার সুযোগ দেন।
সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী জেনারেল জিয়া
১৯৭৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল জিয়া এক ফরমান জারির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে সব ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নামে নিজের হাতে কুক্ষিগত করেন। জিয়া একাধারে রাষ্ট্রপতি, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে থেকে ১৯৭৮ সালের ৩ জুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ঘোষণা দেন।
কারচুপির দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন
১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জিয়া সরকারের নিয়ন্ত্রণে এই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও দুর্নীতি হয়। বিএনপির গুণ্ডাবাহিনী ঢালাও হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শন করে। ব্যবহার করা হয় সেনাবাহিনীসহ সরকারি কর্মকর্তাদের। ক্ষমতার অপব্যবহার করে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, পিডিবি এবং নেজামে ইসলামের যুদ্ধাপরাধীদের সমন্বয়ে গড়া সম্পূর্ণ নতুন জোট ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগকে দেয়া হয় ২০টি আসন। ভোট ডাকাতি ও মিডিয়া ক্যুর মাধ্যমে জিয়ার নিজের দল বিএনপিকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ২০৭টি আসনে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিএনপির মনোনয়নে বিপুলসংখ্যক দালাল ও স্বাধীনতাবিরোধীকে বিজয়ী করে জাতীয় সংসদে আনা হয়।
কলঙ্কিত মাগুরা-২ উপনির্বাচন
এরশাদের নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের যুগে ১৯৯৪ সালের ২০ মার্চ মাগুরা-২ উপনির্বাচন কারচুপির নির্বাচনের প্রতীক হয়ে ওঠে। সেখানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ, ভোটকেন্দ্র দখল, পোলিং এজেন্টদের বের করে দেয়া, ব্যালট বাক্স ভর্তি ও ছিনতাই এবং ভোটারদের ভয় দেখানোর মতো ঘটনা ঘটেছিল, বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি নেতারা ছিল। আওয়ামী লীগের সদস্যের মৃত্যুতে আসনটি শূন্য হয়। বিরোধী দল আওয়ামী লীগ কারচুপির নির্বাচনী ফলাফল সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন নির্বাচনের দাবি জানায়। ২৩ মার্চ সারাদেশে আওয়ামী লীগের ডাকে হরতাল পালিত হয়।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন সহিংস একদলীয় ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকাকালে নির্বাচন কলুষিত করার অন্যতম কলঙ্কজনক উদাহরণ হচ্ছে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। এই নির্বাচনে ভোটারের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। সহিংসতা, ব্যালট স্টাফিং, জালিয়াতির অভিযোগ এবং দুর্বল অংশগ্রহণে পরিপূর্ণ ছিল। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে গঠিত সরকার ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পদত্যাগে বাধ্য হয়।
২০০১-এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে কারচুপি এবং সহিংসতা
বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে গণ্য করা হয়। নির্বাচনের সময় এবং পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন ও নিপীড়ন করা হয়। এ সময় জঙ্গি সংগঠনের ব্যাপক উত্থান এবং তাদের তৎপরতা বিপজ্জনকভাবে বৃদ্ধি পায়। বিএনপির হত্যা ও প্রতিহিংসার রাজনীতির ভয়াল নজির হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা। বিএনপি ও তাদের দোসররা, জামায়াত, জঙ্গিগোষ্ঠী যদি রাজনীতিতে দাপিয়ে বেড়ায়, তাহলে এই অপরাজনীতি বন্ধ হবে না।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যে রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র এবং নির্বাচন বলে আন্দোলনের নিষ্ফল হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার স্বাদ ভক্ষণ করতে পারছে না- সেই বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল তখন তারা দেশের যে ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল ২১ আগস্ট তার মাত্র একটি জঘন্যতম উদাহরণ। এমতাবস্থায় আইন অনুযায়ী নির্বাচন প্রক্রিয়া অব্যাহত এবং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমেই সামরিক একনায়ক কর্তৃক সূচিত অপকীর্তির নির্বাচনের কারচুপির ধারা থামিয়ে দেয়া সম্ভব।

ড. অরুণ কুমার গোস্বামী : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
drgoswami61@yahoo.com

একই লেখা

Leave a Comment