বৈশ্বিক সম্পর্ক উন্নয়ন : কৌশলে এগোচ্ছেন শেখ হাসিনা

মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী

by bdnewsinsider

টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর দেশি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ববাস্তবতার অভিজ্ঞতা দেশ পরিচালনায় কাজে লাগাতে চাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ একসময় বিশ্বের ধনী দেশগুলোর চোখে খুব একটা পড়ত না। সে কারণে কে সরকার গঠন করল কি করল না অনেকের কাছেই বিষয়টি গুরুত্ব পেত না। সরকারপ্রধানের অনেকেই চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকতেন বড় কোনো দেশ তাদের আমন্ত্রণ জানায় কি না এবং আমন্ত্রণ জানানোর জন্য নেপথ্যে যোগাযোগ, তদবির যে করা হতো তাও বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু গত দেড় দশকে ভূরাজনৈতিক ও ভূ-অর্থনৈতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় অনেকের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের প্রতি কতটা দৃষ্টি রাখছেন তা তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে স্পষ্ট। বাংলাদেশ অবশ্য এমন বিতর্কে অংশ নেয় না। কারণ বাংলাদেশের নীতি সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। ফলে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বদরবারে অনেকটাই বেড়েছে, যা অতীতে কল্পনাও করা যায়নি।

বৈশ্বিক পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে কোনো নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেক দেশ থেকেই সরকারপ্রধানকে সেসব দেশে সফরের আমন্ত্রণ জানানো হয় কিংবা সেসব দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার নানা প্রতিশ্রুতি জানিয়ে চিঠি দেয়, সরকারি পর্যায়ের প্রতিনিধিদের আসা-যাওয়া শুরু হয়। এবারও ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে এবার বিশ্ব পরিস্থিতিতে নানা ধরনের সমীকরণ চলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ বছরই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতে যাচ্ছে, ভারতে অনুষ্ঠিত হচ্ছে লোকসভা নির্বাচন, চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ। ইসরায়েল-ইরানের মধ্যকার পরিস্থিতি মোড় নিতে যাচ্ছে কি না এ নিয়ে শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, ইউরোপ-আমেরিকাও বেশ জটিল কূটনৈতিক পর্বে আটকে গেছে। এ অবস্থায় সব দেশেরই নিজস্ব বাস্তবতা এবং ভবিষ্যৎ দেখার নীতি-কৌশল নিয়ে কথা বলতে হয়, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হয়। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খুব ভালো করেই বুঝেশুনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। চীনের পক্ষ থেকে তাকে দেশটি সফরের জন্য ইতোমধ্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আরও কোনো কোনো দেশ থেকেও সেরূপ আমন্ত্রণ জানানোর আভাস-ইঙ্গিত মিলছে। তবে এবার প্রধানমন্ত্রী তার বিদেশ সফরে একটু ধীরে চলার নীতি অনুসরণ করছেন।

শেখ হাসিনা এ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে যান জার্মানিতে ১৬-১৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে। সেখানে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যায় নিরীহ মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার কথা বিশ্বনেতাদের কাছে তুলে ধরেন। একইভাবে তিনি ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধেরও দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী বিশ্বকে যুদ্ধ নয়, উন্নতি ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেওয়ার যে সর্বজনীন মানবতাবাদী ভাবাদর্শের পথে পরিচালিত করার আহ্বান জানান সেটি বিশ্বের পরাশক্তিসমূহ উপলব্ধি না করতে পারলেও ছোট দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে। সে কারণেরই বর্তমান বিশ্বপরিসরে শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত। বিশ্বের শান্তিপ্রিয় জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্র শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের এ ভূমিকাকে যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গেই দেখে।

শেখ হাসিনা বর্তমান বিশ্ববাস্তবতায় কূটনীতিতে নতুন কৌশলে এগোচ্ছেন। তিনি এ মুহূর্তে বড় শক্তিধর রাষ্ট্রে সফর করা কিংবা তাদের আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষেত্রে ভিন্ন কৌশলে এগোচ্ছেন। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে বাংলাদেশ সফরের ব্যবস্থা বেশ চমকপ্রদ। কাতার এ সময়ে মধ্যপাচ্যে অন্যতম ধনী রাষ্ট্রই শুধু নয়, মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা দুনিয়ার অনেক রাষ্ট্রের গভীর আগ্রহের অন্যতম শীর্ষ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত। কাতার এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধসহ নানা ধরনের সমস্যা সমাধানে ভূমিকাও রাখছে। ১৯৭৪ সালে কাতার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। দুই দেশের কূটনীতির সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তিতে কাতারের আমির বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কাতার আমিরের বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আল থানি ১৯৯৫ সালে কাতারের আমির নিযুক্ত হন। কাতারকে উন্নত-সমৃদ্ধ করার পরিকল্পনা তার হাতেই নেওয়া হয় বলে অনেকে মনে করেন। তিনি ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। ২০১৩ সালে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে ক্ষমতা ছেড়ে তিনি ছেলে শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানিকে দায়িত্ব হস্তান্তর করেন। থানির বাবার আমলেই কাতার পৃথিবীর অন্ততম ধনী দেশের তালিকায় নাম লেখায়।

বর্তমান আমির কাতারকে শুধু ধনীই নয়, আন্তর্জাতিক বহুমাত্রিক সম্পর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসেন। কূটনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ছাড়াও ক্রীড়ায় দেশটি আন্তর্জাতিক ভ্যেনু হিসেবে পরিণত হয়েছে। দেশটি একটি পর্যটনের দেশও। মাত্র ২৮ লাখ মানুষের দেশটি এখন উন্নতি-সমৃদ্ধি, সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, তথ্যপ্রযুক্তিসহ সব ক্ষেত্রেই নিজেকে তুলে ধরার শীর্ষ অবস্থানে। বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে কাতারের আমির ঢাকায় যে কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করলেন তা সব বিবেচনায়ই ঐতিহাসিক স্মারক স্থাপনের মতো। তার এ সফরে ১০টি চুক্তি ও স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার গুরুত্ব যেমন অনেক বেশি, তেমনি কাতারের আমির এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি কথা, আলোচনা, দেখাসাক্ষাৎও কোনো অংশেই কম গুরুত্বে বিবেচনার না। দুই নেতার উপস্থিতিতে  দুই দেশের বহুমাত্রিক সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শেষে পাঁচটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারক সই করেছেন। দু’দেশের মধ্যে যে পাঁচটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় সেগুলো হলো বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে আয়ের ক্ষেত্রে দ্বৈত কর পরিহার এবং রাজস্ব ফাঁকি প্রতিরোধ; বাংলাদেশ সরকার এবং কাতার রাষ্ট্রের মধ্যে আইনি ক্ষেত্রে সহযোগিতা; কাতার এবং বাংলাদেশের মধ্যে সমুদ্র পরিবহন; বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে পারস্পরিক বিনিয়োগ উন্নয়ন ও সুরক্ষা; বাংলাদেশ-কাতার যৌথ ব্যবসায়িক পরিষদ প্রতিষ্ঠা।

দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) হলো জনশক্তি কর্মসংস্থান (শ্রম); বন্দর (এমডব্লিউএএনআই কাতার ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ); বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা; যুব ও ক্রীড়া ক্ষেত্রে সহযোগিতা এবং বাংলাদেশ ও কাতারের মধ্যে কূটনৈতিক প্রশিক্ষণে সহযোগিতা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ চুক্তি ও সমঝোতা ছাড়াও কক্সবাজারে বিনিয়োগের জন্য কাতারের আমিরকে অনুরোধ জানান, মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হচ্ছে। এসব বিবেচনায় নিয়ে পর্যটন খাতের বিকাশে কক্সবাজারে বিনিয়োগ করার কথা আমিরকে জানান। প্রধানমন্ত্রীর এ প্রস্তাবে কাতারের আমির ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন এবং তিনি দেশে ফিরে কাতারের বিনিয়োগ বোর্ডসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এসব সুযোগ কাজে লাগানোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেবেন বলে প্রধানমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করে গেছেন। কাতারের আমিরের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান সংকট নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে। দুই নেতাই ওই অঞ্চলে যুদ্ধ যাতে সম্প্রসারিত না হতে পারে সে ব্যাপারে অভিন্ন মত পোষণ করেন। কাতার বিশেষভাবে এ ব্যাপারে যেন সক্রিয় ভূমিকা পালন করে শেখ হাসিনা তাকে সে অনুরোধ করলে তিনি তাতেও সম্মতি প্রদান করেন। কাতারের আমিরের সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়েও ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।

মিরপুরের কালশীতে একটি পার্ক ও সড়কের নামকরণ কাতারের আমিরের নামে করা হলে তিনি গণভবন থেকে অনলাইনে তার উদ্বোধন করেন। বাংলাদেশের উন্নতির কথা তিনি শুনেছেন এবং সফরকালে সচক্ষে দেখে বলেছেন, ‘সিয়িং ইজ বিলিভিং’। এরপর তিনি রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে মধ্যাহ্নভোজ শেষে এলিভেটেড এক্সপ্রেসের ওপর দিয়ে ঢাকা বিমানবন্দরে আসেন এবং দেশে ফিরে যান। ব্যাংককে ইউনাইটেড নেশনস ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক (ইএসসিএপি) তথা এসকাপের ৮০তম সম্মেলনে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনের আমন্ত্রণে ২৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পৌঁছান। তিনি ২৫ এপ্রিল সকালে এসকাপের সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে আসিয়ানসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলিদের গণহত্যা বন্ধের আহ্বান জানান।

এসকাপের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শান্তিশৃঙ্খলাসহ যাবতীয় ব্যাপারে সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। একই সঙ্গে তিনি থাইল্যান্ডের সঙ্গেও বাংলাদেশের কূটনৈতিক, ব্যবসাবাণিজ্যিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে সে দেশের সরকার ও ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গেও আলোচনা করেন। ২৬ এপ্রিল সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাই প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও একান্ত বৈঠকের পর পাঁচটি দ্বিপক্ষীয় নথি—একটি চুক্তি, তিনটি সমঝোতা স্মারক ও একটি আগ্রহপত্র (এলওআই) স্বাক্ষরিত হয় দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে। প্রধানমন্ত্রীর এ সফর ছোট দেশ থাইল্যান্ডে হলেও এটি আমাদের প্রায়-প্রতিবেশী এবং সেখানে আন্তর্জাতিক সম্মেলন হওয়ার ফলে উপস্থিত বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠতা, কূটনীতি ইত্যাদি বহু সম্পর্কীয় বিষয় এক সফরেই তিনি ঘটাতে ভূমিকা রাখবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

  • রাজনীতি-বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ

একই লেখা

Leave a Comment