বইমেলা, বাংলাদেশ আর শেখ হাসিনা, এরা একে অপরের পরিপুরক

-ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)

by bdnewsinsider

পঞ্চম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব গ্রহণের রেকর্ডটি করার অল্প কদিনের মাথায়ই আরেকটি রেকর্ড করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একুশবারের মতো অমর একুশে গ্রন্থমেলা উদ্বোধনের এই অনন্য রেকর্ডটি ভবিষ্যতে আর কেউ ছুঁয়ে দেখতে পারবেন- এমন সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঝুড়িতে এমনি সব রেকর্ডের কোনো ইয়ত্তা নেই। দেশের টাকায় পদ্মা সেতু, দেশের সমুদ্রে সাবমেরিন আর দেশের আকাশে স্যাটেলাইট জুড়ে দেওয়ার মতো অসংখ্য-অজস্র রেকর্ডের অধিকারী তিনি।

তিনিই সেই মহীয়সী নারী, যিনি পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক শিক্ষার্থীকে যেমন বিনামূল্যে বই দেওয়ার রেকর্ডের অধিকারী, তেমনি পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক গৃহহীনকে নিশ্চিন্তে একটি ঘুমানোর ছাদ জোটানোর রেকর্ডটাও তারই বগলদাবায়। তারপরও বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলার প্রসঙ্গটি কিছুটা ভিন্ন। বইমেলার মানদণ্ডে আমাদের ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপী বইমেলাটি অবশ্যই প্রণিধানযোগ্য। কারণ ফ্র্যাঙ্কফুর্ট আর নয়াদিল্লির বইমেলার মতো দু’একটি বইমেলা বাদ দিলে বাংলা একাডেমির বইমেলার সঙ্গে পাল্লা দেয় এমন দুঃসাহস কোন মেলার? তবে আমাদের বইমেলার গুরুত্বটা শুধু এখানেই নয়, বরং তা একাডেমির গণ্ডি পেরিয়ে আরও বহু বিস্তৃত।
বাঙালি জাতির জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত সফল পরিণতি বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। তার  নেতৃত্বে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ^ মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে। ২৪ বছরের দীর্ঘ বন্ধুর পথ চলা শেষে আমাদের ক্যালেন্ডারে এসেছিল ডিসেম্বরের ১৬। আর এই পথ চলার আনুষ্ঠানিক সূচনাটাও বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে।

যার ধারাবাহিকতায় ৫২-এর ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখে সালাম-রফিক-বরকত-শফিক-জব্বারের মতো তরতাজা তরুণরা বুকের রক্ত ঢেলে মায়ের ভাষার দাবিতে ঢাকার রাজপথের কালোকে লালে মুড়ে দিয়েছিলেন। বাংলা একাডেমির বইমেলা তাই শুধু নিছক একটি বইয়ের  মেলাই নয়, এটি বাঙালি আর বাঙালিত্বের এক বিশাল উদযাপনও।

বিএনপি জোট সরকারের জমানায়, গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিককার আঁধার দিনগুলোতে এই বইমেলাই ছিল একমাত্র জায়গা, যেখানে গেলে মনে হতো প্রাণ খুলে, স্বাধীন দেশে মুক্ত বায়ুতে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছি। এই একটি জায়গায়ই বাজত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ। আর ঝালমুড়ি, চিনা বাদামের প্যাকেট হাতে চলত কোনো একদিন দেশটার চালকের ভূমিকায় আবারও স্বাধীনতার পক্ষের শক্তিকে দেখার স্বপ্নের জাল বোনাবুনি। বইমেলা জিয়া-এরশাদ-খালেদা জমানার দুঃসহ দিনগুলোতে এদেশের স্বাধীনতাকামী, প্রগতিশীল মানুষগুলোকে শক্তি যুগিয়ে গেছে নিরন্তর।
এসব বিষয় যেমন অমর একুশে বইমেলার অনস্বীকার্য অনুষঙ্গ, তেমনি এটাও ঠিক যে, এই বইমেলাকে কেন্দ্র করে জন্ম হয়েছে অসংখ্য লেখক-কবি-সাহিত্যিক, যাদের হাত ধরে সমৃদ্ধ হয়েছে বাঙালি আর তার সাহিত্য। লিটল ম্যাগাজিন থেকে শুরু করে ছোট গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা ইত্যাকার সাহিত্যের নানা অঙ্গনে যারা দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, বেড়াচ্ছেন এবং ভবিষ্যতে বেড়াবেন, এমনি অনেকের সূচনাই বাংলা একাডেমি চত্বরের এই বইমেলা থেকে।

বইমেলার কারণেই বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প ঋব্ধ ও পরিপুষ্ট হয়েছে। আজ যে প্রতি ফেব্রুয়ারিতে হাজারো নতুন বইয়ের সুবাসে ম ম করে বাঙালির আকাশ-বাতাস, সে এই বইমেলার সুবাদেই। সামনে যখন আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর, তখন সেই স্মার্ট দেশের স্মার্ট ডিজিটাল বইগুলোও এই বইমেলাকে কেন্দ্র করেই প্রকাশ ও বিকশিত হবে, তেমনটা প্রত্যাশা করাই যায়।
একুশ বারের মতো বইমেলার উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর যে নাতিদীর্ঘ, জ্ঞানগর্ভ ভাষণ, সেখানে এসব বক্তব্যই প্রতিভাত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার স্বভাবসিদ্ধ বাগ্মীতায় এ সমস্ত বিষয় এমনই দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন যে, এ নিয়ে চর্বিতচর্বণে দেশের শীর্ষ দৈনিকের পাতা দখল নিষ্প্রয়োজন। তারপরও কলম ধরার উদ্দেশ্য একটাই। প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের সেই ভাষণ শুনতে গিয়ে এবং অতঃপর ভাষার মাসের সূচনালগ্নে বাংলাদেশ  টেলিভিশনের একটি টকশোতে তা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মনে হলো, বইমেলার ‘ভাব সম্প্রসারণ’ যদি হয় বাংলাদেশ, তবে তার ‘এক কথায় প্রকাশ তো’ শেখ হাসিনা।

এই বইমেলার অঙ্গনে বান্ধবী বেবি মওদুদের সঙ্গে লাইব্রেরীতে সময় কাটিয়ে যে কিশোরী শেখ হাসিনার বিকাশ, বাঙালি জাতির নবমুক্তি, জননেত্রী সেই শেখ হাসিনার লেখক সত্তার পরিপূর্ণতাও তো এই মেলা থেকেই। বইমেলা আমাদের অনেক কিছুই দিয়েছে যার সব কিছুকে এক কথায় প্রকাশ করলে তা ছোট হয়ে এসে দাঁড়ায়। কবি বলেছিলেন, ‘শেখ হাসিনা, আপনিই তো বাংলাদেশ’। আমার কাব্য প্রতিভা শূন্যের কোঠায়। তারপরও কেন যেন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, বইমেলা, বাংলাদেশ আর শেখ হাসিনা, এরা একে অপরের পরিপুরক এবং সম্পুরক বৈ আর কিছু না।

লেখক : অধ্যাপক, ডিভিশন প্রধান,
ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় ও
সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

একই লেখা

Leave a Comment